ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের থানা-ওয়ার্ড-ইউনিয়নের পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন সম্পর্কে এবার প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় নেতারা। তাদের অভিযোগ, উত্তর আওয়ামী লীগ সভাপতি একেএম রহমতুল্লাহ এমপি ও সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান অনুমোদিত পূর্ণাঙ্গ কমিটিগুলোতে ত্যাগী ও দক্ষ নেতাদের স্থান হয়নি। অর্থের বিনিময়ে কমিটিতে বিএনপি-জামায়াত-ফ্রিডম পার্টির নেতাকর্মীসহ সন্ত্রাসী-জঙ্গি ও মাদক ব্যবসায়ীদের ঠাঁই দেওয়া হয়েছে। এদিকে, তদন্তের আগে কমিটি প্রকাশ না করার নির্দেশ দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। আপাতত অনুমোদিত কমিটিগুলো স্থগিত থাকবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী আরও জানিয়েছেন যে, উত্তরের কমিটি গঠনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতা ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খানের স্বাক্ষর ছাড়া কোনো কমিটিই গ্রহণ করা হবে না। তা ছাড়া কমিটি ঘোষণার আগে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা আরও যাচাই-বাছাই করবেন। বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে প্রকৃত আওয়ামী লীগ নেতাদের দিয়েই সব পর্যায়ের কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হবে। এসব কমিটি থানা-ওয়ার্ড-ইউনিয়ন নেতাদের মাধ্যমেই পূর্ণাঙ্গ করা হবে বলেও জানান তিনি।
নগর উত্তর আওয়ামী লীগের অন্তর্গত ২৬টি থানা, ৪৬টি ওয়ার্ড ও নয়টি ইউনিয়নের পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যেই গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন নেতারা। তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা কথা বলেন।
সূত্র জানায়, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী থানা-ওয়ার্ড নেতাদের কাছে পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন কে দিয়েছে, তা জানতে চান। এ সময় নেতারা উত্তরের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম বললে সেখানে ফারুক খানের স্বাক্ষর আছে কি-না সেটিও জানতে চান। নেতারা না সূচক জবাব দিলে প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দেন, ফারুক খানের স্বাক্ষর ছাড়া কোনো কমিটি অনুমোদন হবে না। কেননা তিনিই (প্রধানমন্ত্রী) ফারুক খানকে দায়িত্ব দিয়েছেন, সব অভিযোগ তদন্ত করে কমিটি চূড়ান্ত করতে। আপাতত সব কমিটি স্থগিত থাকবে।
এ সময় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে থানা-ওয়ার্ড নেতারা উত্তরের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক অনুমোদিত পূর্ণাঙ্গ কমিটিগুলোতে ঠাঁই পাওয়া বিতর্কিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নানা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে ধরে আলাদা আলাদা তালিকা জমা দেন। প্রধানমন্ত্রী এগুলো বিবেচনার আশ্বাস দিয়ে বলেন, উত্তরের কমিটি গঠন ও পূর্ণাঙ্গকরণে দায়িত্বপ্রাপ্ত সমন্বয়ক ফারুক খান, দলের ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি এবং সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এগুলো যাচাই-বাছাই করবেন। এর আগে কোনো কমিটি অনুমোদন কিংবা ঘোষণা করা হবে না।
বৈঠকে উপস্থিত মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের দারুস সালাম থানা সভাপতি এ বি এম মাজহারুল আনাম সমকালকে জানান, ১৫/১৬টি থানা ও ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। তাদের সবারই অভিযোগ, ৯০ ভাগ প্রকৃত আওয়ামী লীগ নেতাদের বাদ দিয়ে কমিটিগুলো পূর্ণাঙ্গ করা হয়েছে। যারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, তাদের বেশিরভাগের বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াত ও ফ্রিডম পার্টির রাজনীতি এবং সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ ও মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এদের অন্তর্ভুক্ত করার সময় মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আপাতত পূর্ণাঙ্গ কমিটিগুলো স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের খান, পল্লবী থানা সভাপতি ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ এমপি, আদাবর থানা সভাপতি এম এ মান্নান, মিরপুর থানা সভাপতি এস এম হানিফ, বনানী থানা সভাপতি এ কে এম জসিম উদ্দিন, শাহ আলী থানা সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম মোল্লা, বিমানবন্দর থানা সাধারণ সম্পাদক মাকসুদুর রহমান মাসুম, খিলক্ষেত থানা সাধারণ সম্পাদক আসলাম উদ্দিন বেপারী, ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জামাল হোসেন ও ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সভাপতি ওমর ফারুকসহ বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা।
গত ২৭ ডিসেম্বর নগর উত্তরের অন্তর্গত ২৬টি থানা, ৪৬টি ওয়ার্ড ও ৯টি ইউনিয়নের পূর্ণাঙ্গ কমিটিকে অনুমোদন করেন উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম রহমতুল্লাহ ও সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান। শীর্ষ দুই নেতার স্বাক্ষরে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কমিটি অনুমোদনের কথা জানানো হয়। তবে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে স্থগিত থাকার পাঁচ মাস পর আবারও ‘অভিযুক্ত’ কমিটিগুলোকে আবারও অনুমোদন দেওয়া নিয়ে তখনই প্রশ্ন ওঠে। এমনকি কমিটি পূর্ণাঙ্গকরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক কেন্দ্রীয় নেতাও বলেন, এ বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না। বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা তখন এ নিয়ে আবারও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন।
এর আগে গত ৫ জুলাই একই কমিটির অনুমোদন দেন উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের অভিযোগের কারণে তখন অনুমোদনের একদিনের মাথায় সব কমিটি স্থগিত করেন শেখ হাসিনা। এরপর তিনি কেন্দ্রীয় নেতাদের ওই কমিটির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেন। দলীয় সভাপতির নির্দেশে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অনেকগুলো অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব দেন ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি ও সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে। এ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খানকে দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দলীয় সূত্রমতে, অভিযোগের প্রতিটিই যাচাই-বাছাই করে রিপোর্ট তৈরি করেছেন মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের এ-সংক্রান্ত ধারাবাহিক বৈঠকের ফাঁকেই গতকাল আবারও কমিটিগুলো অনুমোদন করেন এ কে এম রহমতুল্লাহ ও সাদেক খান। মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান আসন্ন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদের উপনির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে আগ্রহী।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সভাপতিম লীর সদস্য ফারুক খান জানান, প্রধানমন্ত্রী জুলাই মাসেই উত্তরের নেতাদের বলেছিলেন, তাকে (ফারুক খান) দেখিয়ে কমিটিগুলোর অনুমোদন চূড়ান্ত করতে। কিন্তু মহানগর উত্তরের নেতারা কখন, কোথায়, কাদের সঙ্গে আলাপ করে আবারও পাঁচ মাস পর একই কমিটির অনুমোদন দিয়েছেন, সেটি তার জানা নেই।
তবে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার নির্দেশনা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলেই পূর্ণাঙ্গ কমিটিগুলো অনুমোদন দিয়েছিলেন- এমনটি দাবি করেছেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান। তিনি বলেন, নেতারা গণভবনে গিয়েছিলেন বলে শুনেছেন তিনি। তবে কমিটি স্থগিতের কোনো খবর শোনেননি বলেন জানান এ নেতা। সূত্র:-সমকাল
পাঠকের মতামত